“আর্ট অব ওয়ার” শুধুমাত্র একটি বই নয়, এটি যুদ্ধের কৌশল এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে লেখা একটি অনন্য গ্রন্থ। চীনের প্রাচীন সমরবিদ সানজুর এই বিখ্যাত গ্রন্থটি যুদ্ধজয়ের পরিকল্পনা, কৌশল এবং আত্মবিশ্বাসের গুরুত্ব তুলে ধরে। এই পোস্টে আমরা “আর্ট অব ওয়ার” বইয়ের বিষয়বস্তু এবং সেখান থেকে অর্জিত শিক্ষাগুলো নিয়ে আলোচনা করব, যা আমাদের বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে।
মানবজাতি এবং যুদ্ধ: এক অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস
মানবজাতির ইতিহাস আসলে যুদ্ধের ইতিহাস। মানবজাতি সব সময় কোন যুদ্ধ পরবর্তী, যুদ্ধকালীন কিংবা যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে অবস্থান করে থাকে। আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতি যুদ্ধে নিমজ্জিত। যুদ্ধ অনেক কারণেই হতে পারে। তবে ক্ষমতা এবং রাজ্য জয়ের লক্ষ্যেই মানুষ একে অপরের সাথে সবচাইতে বেশি যুদ্ধে জড়িয়েছেন। এই দেখুন না কিছুদিন আগেই রাশিয়া এবং ইউক্রেন পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো।
যুদ্ধে জয়: শুধু সেনাবাহিনীর শক্তি নয়, কৌশলের ভূমিকা
সব পক্ষই আসলে যুদ্ধে জয়ী হতে চায় এবং তারা যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য গড়ে তোলে বিশাল সেনাবহর। অনেক সময় শুধুমাত্র বিশাল সেনাবহর দিয়ে যুদ্ধে জয় পাওয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে যায়। যুদ্ধে জয় পেতে হলে প্রয়োজন হয় দক্ষ সেনাসদস্য, সেনানায়ক এবং সেইসাথে যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে থাকা প্রয়োজন সম্যক ধারণা। প্রয়োজনের সময় সেই সম্যক ধারণা কে প্রয়োগ করতে পারতে হয়। তবেই যুদ্ধে জয় পাওয়া সম্ভব।
সানজু এবং ‘দি আর্ট অব ওয়ার’: এক অনন্য সমরবিদ
অতি প্রাচীন কালে চীনে একজন বিখ্যাত সমরবিদ ছিলেন যাকে আমরা সানজু নামে চিনে থাকি। তিনি যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম হলো “দি আর্ট অব ওয়ার।” আজকে আমরা সেই বইটি রিভিউ করতে চলেছি।
‘দি আর্ট অব ওয়ার’ বই: কী শিখতে পারি আমরা?
আগেই বলেছি বইটি মূলত যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল এর সমন্বয়ে লেখা। তবে মজার ব্যাপার হলো বইটি থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা কিন্তু আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। আফটার অল জীবন তো যুদ্ধই।
আমরা বইটাকে রিভিউ করবো দুইটা পার্টে। প্রথম পার্টে আমরা দেখব যে বইটাতে কী কী কনটেন্ট আছে এবং দ্বিতীয় পার্টে আমরা দেখব এই বই থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা কিভাবে আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারি।
যুদ্ধ পরিকল্পনা: জয়ের প্রথম শর্ত
যুদ্ধে জেতার জন্য সানজু প্রথমে যে কৌশলের কথা বলছেন সেটা হল পরিকল্পনা। যেই সেনাদল যুদ্ধের জন্য ভালো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামবে তাদের যুদ্ধে জয়ী হবার সম্ভাবনা শতভাগ। সুতরাং, যুদ্ধে জেতার জন্য অবশ্যই আমাদেরকে একটা ভালো পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সানজু যুদ্ধের নীতি হিসেবে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলছেন। তিনি বলছেন, যে কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলে আপনাকে প্রথমেই যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
যুদ্ধ ঘোষণার গুরুত্ব: আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি
প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে যেই যুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করছি সেটা কি আইনগত নাকি বেআইনি। একটা বেআইনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে সেখানে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। কারণ আপনি মোরালি সেই পরিমাণে শক্তিশালী অবস্থানে থাকেন না। একটা যুদ্ধ বৈধ কিংবা অবৈধ সেটা নির্ভর করে অনেকাংশেই যুদ্ধ ঘোষণার উপর ভিত্তি করে। সুতরাং, আপনি যদি যুদ্ধ ঘোষণা করে কোনো যুদ্ধে নামেন তাহলে ধরেই নেওয়া হবে এই যুদ্ধটা হচ্ছে আইনগত এবং বৈধ।
যুদ্ধ নিষিদ্ধ নাকি আইনসম্মত? ইউএন চার্টারের দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে দেখব ইউএন চার্টারে বলা আছে The Threat or use of force against other state is unlawful. তাহলে আসলে কি যুদ্ধ নিষিদ্ধ???
যুদ্ধ আসলে সব ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ নয়। কিছু কিছু গ্রাউন্ড আছে যে সকল গ্রাউন্ডে আমরা যুদ্ধকে আইনগত বলতে পারি। এর মধ্যে একটা গ্রাউন্ড হচ্ছে self-defense। দ্বিতীয় গ্রাউন্ড হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি। আপনি চাইলে self-defense এবং ইন্টারন্যাশনাল পিস এবং সিকিউরিটি এর জন্য যুদ্ধে জড়াতে পারেন। তবে যুদ্ধটা আইনগত হতে হলে pre-condition টা হচ্ছে অবশ্যই আপনাকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আপনি যদি যুদ্ধ ঘোষণা না করেন তাহলে সেই যুদ্ধকে কোনো সংস্থা বা আন্তর্জাতিক বিশ্ব বেআইনি হিসেবে ট্রিট করবে।
বৈধ যুদ্ধের ভিত্তি: আত্মরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা
সানজুর মতে যুদ্ধে জিততে হলে অবশ্যই আপনাকে যুদ্ধের ময়দানে কৌশলী আক্রমণ এবং কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা না হলে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা কম। তার মতে একজন বিজয়ী রণবীর বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পরেই যুদ্ধে মাঠে নামে। আর যার ভাগ্যে পরাজয় লেখা আছে তিনি প্রথমে যুদ্ধ মাঠে নামেন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধে জয়ী হবার হিসাব করতে থাকেন।
কৌশল এবং আক্রমণ: সানজুর দৃষ্টিতে যুদ্ধে সফলতা
যুদ্ধে জয়ী হতে হলে অবশ্যই আপনাকে আপনার শক্তিমত্তা এবং আপনার সেনাদলের উপরে বিশ্বাস রাখতে হবে। অবশ্যই আপনাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার মতে ক্ষমতা হলো একটি বাঁকা ধনুকের মত যেটা তীর নিক্ষেপের অপেক্ষায় আছে এবং এই তীরটি হলো আপনার সিদ্ধান্ত।
বিশ্বাস এবং শক্তিমত্তা: জীবনের যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি
আমরাও ক্রমাগত জীবন যুদ্ধে লড়াই করে চলেছি। আমরা যদি আমাদের জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে চাই তবে সানজুর এই নীতিগুলো আমরা মেনে চলতে পারি। তাহলে অবশ্যই আমরা আমাদের জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে একধাপ এগিয়ে থাকবো। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ যদি আমরা পরিকল্পনা করে গ্রহণ করি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করি, সেইসাথে পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকি, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি এবং আমরা যদি আমাদের শক্তিমত্তার উপর বিশ্বাস রাখি তবে আমরাও জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো।