নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ এর তুলনাটা আমি লেখক হিসেবে করতে চাইছি না। এই তুলনা অসম তুলনা হবে। উভয়ই লেখক হিসেবে প্রতিভাধর ছিলেন। উভয়েই দুটি ভিন্ন দেশের জাতীয় কবি। আমার তুলনা হবে বাংলাদেশী মানুষের পার্সপেক্টিভ থেকে।
বাংলাদেশের মেজরিটি জনসংখ্যা মুসলিম। তাই অনেকের মনে হতে পারে তুলনা সম্ভবত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করতেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো মুসলিম হওয়াতে নজরুল সিমপ্যাথি পেলেও রবীন্দ্রনাথের উপর ক্ষোভ আছে কয়েকটা কারনে, যা সিমপ্যাথির তুলনায় মানুষের মনকে বেশি প্রজ্জ্বলিত করে।

প্রথমত রবীন্দ্রনাথ সাহেব একজন জমিদার ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি জমিদারদের অত্যাচার-নির্যাতনের কথা তো আর ভুলে যাবার না। দ্বিতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কারন তিনি সরাসরি বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন, স্বদেশী আন্দোলন করেছেন।
মনে রাইখেন বঙ্গভঙ্গ যদি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলতো তাহলে আমাদের পাকিস্তানের হস্তগত হতে হইতো না। সম্ভবত ১৯০৫ সালেই আমরা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইমার্জ করতাম। এতদিনে সেটা শক্ত ভিত পেতো।
তৃতীয় কারনটি ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধিতা করা। যদিও এটা নিয়ে মতবিরোধ আছে, তবে মেজরিটি মনে করেন তিনি বিরোধিতা করেছেন।
এই সমস্ত কারনে বাংলাদেশের মেজরিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে অপছন্দ না করলেও পছন্দ করেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িক এলিমেন্ট বিভিন্ন সময়ে আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যেটা নজরুলে নেই। এখানেই নজরুল অনন্য।
নজরুলের জীবন সংগ্রামের। যা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সাথে এলাইন করে। নজরুল শুধু মুসলমানদের থাকেন না তিনি হিন্দুদেরও কবি হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রে হিন্দু রোল প্লে করেন। নজরুলকে ছোট-বড়, কামার-সূতার, ধনী-গরিব সবাই আপন করে নিতে পারেন।

রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো দর্শনের। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত। সেটা তিনি অনিচ্ছায় করতে পারেন কিন্তু তিনি অনুগত ছিলেন।
ভারতের জাতীয় সংগীত তিনি লিখেছিলেন ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের সময় যুক্তরাজ্যের রাজা পঞ্চম জর্জকে সংবর্ধনা দিতে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের যেই গান ব্যবহার করা হয় সেটিও তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেই লিখেছিলেন। এটা ভিন্ন আলাপ।
অন্যদিকে নজরুল ছিলেন বৃটিশ বিরোধী। সারাজীবন বৃটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন। তার লেখাতে বিদ্রোহের সুর আপনি পাবেন।
এই সমস্ত কারনে হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই নজরুল গ্রহনযোগ্য। জনপ্রিয় না হলেও অজনপ্রিয় নন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেটা অর্জন করতে পারেননি। সবকিছু ছাপিয়ে তারা দুজনই লেখক হিসেবে বাংলা ভাষার সম্পদ।