Wednesday, September 17, 2025

বই পর্যালোচনা: বাংলাদেশের রক্তের ঋণ — অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের কলমে ইতিহাসের রক্তাক্ত দশক

বাংলাদেশের রক্তের ঋণ

Share

ভূমিকা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের এক দশকজুড়ে ঘটে গেছে ভয়াবহ সামরিক অভ্যুত্থান, শেখ মুজিবের নির্মম হত্যা, নেতৃত্বের পালাবদল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই রক্তাক্ত অধ্যায় নিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস লিখেছেন ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাংলাদেশের রক্তের ঋণ। আমরা আজকে সেই বইটি নিয়েই পর্যালোচোনা করবো —

ভারতের বিভাজন ও পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূচনা

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হল। একটি পাকিস্তান এবং অন্যটি ভারত। পাকিস্তান রাষ্ট্র হলো ভারতবর্ষের যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জন তাদেরকে নিয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। পাকিস্তানের আবার দুটি অঞ্চল। একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই বাংলা ভাষাভাষী। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষজন উর্দুতে কথা বলে। প্রথমেই এই রাষ্ট্রে যে সমস্যা সৃষ্টি হলো সেটি হচ্ছে এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উপরে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষজন এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলেন।

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম

তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকরা প্রতিবাদরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে নিহত হন রফিক, জব্বা্র,‌ শফিক ও বরকত সহ আরো অনেকে। শুরু হল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আবারও নতুন করে স্বাধীন হবার জন্য নতুন স্বাধীনতা সংগ্রামের।

ইতিমধ্যেই ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী হয়ে গিয়েছে সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। তাদেরকে জনগণ সরকার গঠনের ম্যান্ডেট প্রদান করেন। কিন্তু সেই সময়ের যে মিলিটারি শাসকরা ছিল তারা বিভিন্ন কারণে তৎকালীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। জনগণ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। তারা সারা দেশব্যাপী হরতাল পালন করে, বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে।

২৫ মার্চের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জেনারেল অ্যাসেম্বলির মিটিং হওয়ার কথা ছিল। সেটা ইয়াহিয়া খান বাতিল করে দিলে দফায় দফায় মিটিং হয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে। কিন্তু কোনোভাবেই মিলিটারি শাসকরা আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন না। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ঘুমন্ত বাংলাদেশি মানুষদের উপরে নেমে এলো পাকিস্তানি মিলিটারির বর্বর অত্যাচার এবং নির্যাতন। পাখির মতো গুলি করে সাধারণ জনগণকে তারা হত্যা করলো। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক সংকট

সেই সময়ের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। এই যুদ্ধে আপামর জনতার পাশাপাশি তাদের সাথে যোগ দিলেন বিভিন্ন মিলিটারি অফিসার। সামরিক এবং বেসামরিক জনগণ একত্রিত হয়ে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করলেন।

পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠন এর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি শুরু করলেন এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনরায় গড়ে তোলার কাজ। কিন্তু বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে তিনি আশানুরূপভাবে সফল হতে পারছিলেন না।

বাকশাল গঠন ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড

তার দলের কিছু নেতা কর্মী বেরিয়ে গিয়ে গঠন করলেন জাসদ। আবার যারা কমিউনিস্ট মতাদর্শে ছিলেন তারা দেশকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিণত করার জন্য চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করে দিলেন। এই কারনে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। একইসাথে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনগণ একটি দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করে। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যের যে খুব বেশি পরিবর্তন হলো তেমন নয়।

যখন দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না, দেশের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাতের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে, সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেন। তিনি এটাকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেন। বাংলাদেশকে গড়ার জন্য তিনি পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য সচেষ্ট হন। কিন্তু তার এই আশা দুরাশায় হয়ে থাকল। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হলেন।

পরবর্তী অভ্যুত্থান ও ক্ষমতার পালাবদল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসীন হন খন্দকার মোশতাক। তার সাথে সেই সকল মিলিটারি পার্সোনেল যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেন। কিন্তু খন্দকার মোশতাকের শাসন খুব বেশি দীর্ঘ হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা হত্যা করেন তাদেরকে বঙ্গভবন থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। সেই সময়ে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন খালেদ মোশাররফ এবং বন্দী করেন সেই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে।

তৃতীয় অভ্যুত্থান ও জিয়াউর রহমানের উত্থান

পরবর্তী সময়ে জাসদের গণবাহিনী ও জাসদের কন্ট্রোলে থাকা আর্মির মধ্যে যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ছিল তারা সম্মিলিতভাবে তৃতীয় অভ্যুত্থান করেন এবং খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেন। এই তৃতীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন এবং বাংলাদেশ শাসন করেছেন।

রক্তাক্ত ইতিহাস ও মাসকারেনহাসের বই

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানে কি কি ঘটেছে ও ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলো এই পর্যন্ত সময়ের ঘটনাপ্রবাহ গুলো নিয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস একটি বই লিখেন। বইটির নাম হচ্ছে বাংলাদেশ এ লেগেসি অফ ব্লাড। যার বাংলা নাম হচ্ছে বাংলাদেশ, রক্তের ঋণ।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই যে ক্রমাগত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, খালেদ মোশারর্‌ফ, জিয়াউর রহমান এবং এই সময়ে মিলিটারি ক্যু’তে অংশগ্রহণকারী অনেকেই নিহত হন। অনেক জনকেই বিচারের আওতায় আনা হয় এবং ফাঁসিতে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আমরা যদি দেখি তাহলে আরো দেখতে পারব যে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও এটা দূরবর্তী কিন্তু তাকেও ফাঁসি দেওয়া হয় এই মিলিটারি কুয়ের অপরাধে।

উপসংহার: একটি জাতির রক্তঋণ ও ইতিহাস জানার দায়

যারা সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করল ও দেশকে স্বাধীন করলো ঠিক তারাই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেয়ে দেশের যারা সর্বাধিনায়ক ছিল, যারা দেশের প্রেসিডেন্ট যারা দেশের প্রধানমন্ত্রী, যারা দেশটাকে গড়ে তুলতে পারত তাদেরকে এইভাবে গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে নিহত করলো।

এই যে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যা, ১৯৭৫ সালে খালেদ মোশাররফের হত্যা এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের রক্তের ঋণ। যারা এই দেশকে স্বাধীন করলো, যাদের হাত ধরে আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম, বিশ্ব দরবারে আমাদের কে পরিচিত করতে পারতাম, আমরা তাদেরকে হত্যা করলাম। আমরা বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে রক্ষা করতে পারলাম না।

১৯৭১ সাল থেকে নিয়ে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত যে ঘটনা প্রবাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের হত্যা এই পুরো বিষয়টা নিয়ে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বইটি লিখেছেন। আমরা যদি অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এর বইটি পড়ি তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে দুঃখজনক ঘটনা এবং সবচাইতে কঠিন সময়ের ইতিহাসটা আমরা জানতে পারব। সবার কাছে আমার রিকমেন্ডেশন থাকবে আপনারা এই বইটি পড়বে্ন। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে মার্ডার করার ঘটনা, জিয়াউর রহমানকে মার্ডার করার ঘটনা ও বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় তিনটি মিলিটারি ক্যু এর ঘটনা সম্পর্কে আপনারা জানতে পারবেন।

Table of Contents

Read more

Related Posts

Join our community of SUBSCRIBERS and be part of the conversation.

To subscribe, simply enter your email address on our website or click the subscribe button below. Don’t worry, we respect your privacy and won’t spam your inbox. Your information is safe with us.

32,111

Followers

32,214

Followers

11,243

Followers