Thursday, June 19, 2025

বুক রিভিউঃ- সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর

সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর

Share

সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর বইটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মেজর হাফিজ উদ্দীন আহমেদ এর বীরত্ব এবং তাঁর চোখের সামনে ৭৫ এ ঘটে যাওয়া তিনটি সেনা অভ্যুত্থানের গল্প। যারা নির্মোহ ইতিহাস জানতে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি অবশ্য পাঠ্য।

আমাদের অনেকেরই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট এবং ৩ থেকে ৭ নভেম্বরে ঘটে যাওয়া সেনা বিদ্রোহ সম্পর্কে কৌতূহলের শেষ নেই। অনেক লেখক মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অনেক বই লিখেছেন।

কিন্তু খুব কম সংখ্যক লেখক-ই নির্মোহভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন সেই সময়ের ইতিহাস। বেশিরভাগ লেখকই বিভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে ইতিহাস উত্থাপন করেছেন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। ফলে এক লেখকের বইতে যিনি নায়ক অন্য বইতে তিনি মূহুর্তেই খলনায়ক বনে যান।

মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়েই ইতিহাসে নায়ক-মহানায়ক বানানোর অশুভ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন বেশিরভাগ লেখক। ফলশ্রুতিতে নির্মোহ ও সত্যভাবে উঠে আসেনি অনেক জানা-অজানা ইতিহাস। অনেকেই মনগড়া কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী না হয়ে অন্যের মলাটে লিপিবদ্ধ তথ্যকে পুঁজি করে লিখেছেন ইতিহাস।

এমন আরো অসংখ্য কারনে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ। মেজর হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রম তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর’ এ নির্মহভাবে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন।

মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন ভোলার লালমোহনে সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা পাকিস্তান আমলে তিনবারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলীয় উপনেতা। শুরুতে মেজর হাফিজ রাজনীতি না করলেও পরবর্তী সময়ে ভোলা-৩ আসন থেকে ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. এবং ১৯৬৫ সালে তিনি এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আর্মিতে কমিশন পান। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বীরবিক্রম খেতাব অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দল এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২০০ সৈনিক নিয়ে বিদ্রোহ করেন এবং প্রবল গোলাবৃষ্টির মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। রনাঙ্গনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বার বার অলৌকিক ভাবে রক্ষা পেয়েছেন শত্রুর বুলেট থেকে। কিন্তু সম্মুখ সমরে হারিয়েছেন কাছের বন্ধু এবং সহযোদ্ধাদের। তার সাবলীল বর্ননায় উঠে এসেছে সেই সময়ের যুদ্ধাবস্থার চিত্র।

একাত্তর পরবর্তি সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং নিজ হাতে সেনাবাহিনী গড়ে তোলার মহান দ্বায়িত্বে সামিল হন। সেনাবাহিনীর ভেতরে থেকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন ৭১ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। সাক্ষী হন ৭৫ এর ১৫ ই আগষ্টের নির্মম হত্যা কান্ডের।

সেই সময় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। ভেঙ্গে পড়া চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে দুঃসাহসী সেনা কর্মকর্তা মেজর হাফিজ সহ আরো কিছু জুনিয়র অফিসার খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশছাড়া হতে বাধ্য করেন।

কিন্তু খালেদ মোশাররফের অদূরদর্শী নেতৃত্ব এবং ক্ষমতার লোভের কারনে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় সেই বিদ্রোহ। জনগন খালেদ মোশাররফকে ভারতের দালাল ভাবতে শুরু করেন। পাল্টে যায় সমস্ত পরিস্থিতি। যেই মহৎ উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করা হয় তা নস্যাৎ হয়ে যায় মূহুর্তেই।

৭ নভেম্বর ঘটে পাল্টা অভ্যুত্থান। যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল তাহেরের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গড়ে তোলা রাজনৈতিক সংগঠনের সামরিক উইং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই স্লোগানে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে তারা বিদ্রোহের সূচনা ঘটায়। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ১৩ জন অফিসারকে। হত্যা করে ৩ নভেম্বর বিদ্রোহের নায়ক খালেদ মোশাররফকে। কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায় ঢাকার আকাশ-বাতাস।

৩ নভেম্বর বিদ্রোহের সূচনা হলে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া পদত্যাগ করেন এবং গৃহবন্দী হন। জিয়াকে বন্দি করে খালেদের সেনাপ্রধান পদে দায়িত্ব গ্রহন সৈনিকরা ভালোভাবে গ্রহন করেনি। ৭ নভেম্বর পাল্টা বিদ্রোহের মাধ্যমে সৈনিকরা তাকে মুক্ত করে।

জাসদ এবং তাহের ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের জনক বলে দাবি করলেও মূলত বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুকের ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদের ২য় ফ্লিড রেজিমেন্ট। মূলত ১৫ই আগষ্টের হত্যাকান্ডের দায় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তারা বিদ্রোহে অংশগ্রহন করে এবং জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে।

৩ নভেম্বর বিদ্রোহের অপরাধে লেখক সহ আরো অনেক অফিসার গ্রেফতার হন। কিন্তু কৌশলে লেখক সহ আরো তিন জন অফিসার পালিয়ে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াই ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে বিদ্রোহ করে বসেন। দফায় দফায় আলোচোনা শেষে, অবশেষে ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে আবসরে যান মেজর হাফিজ। শেষ হয় ৮ বছরের ঘটনাবহুল সৈনিক জীবন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং দেশ ও মানুষের সেবাই নিজেকে আবারো নতুন পরিচয়ে আত্মনিয়োগ করেন।

মেজর হাফিজের ভাষ্যে…

“আজ আমার বয়স ৭৫ পেরিয়েছে। ৩৪ বছর ধরে রাজনীতি করছি। সেনাবাহিনীতে ছিলাম মাত্র আট বছর। এ দেশে রাজনীতি অত্যন্ত ঝক্কিঝামেলার ব্যাপার। নিন্দার সাথে সাথে যশ-গৌরবও মাঝেমধ্যে মেলে। মাঝেমধ্যে মনে হয় ক্যাবিনেট মন্ত্রিত্বের তুলনায় সেনা ক্যাপ্টেনের তৃতীয় ‘পিপ’টি আমাকে অধিকতর আনন্দ দিয়েছে! Nothing like Army, what a way of life!”

Table of Contents

Read more

Related Posts

Join our community of SUBSCRIBERS and be part of the conversation.

To subscribe, simply enter your email address on our website or click the subscribe button below. Don’t worry, we respect your privacy and won’t spam your inbox. Your information is safe with us.

32,111

Followers

32,214

Followers

11,243

Followers