Monday, January 6, 2025

পাকিস্তান কি ১৯৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে?

পাকিস্তান কি ১৯৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে?

Share

একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরে আমাদের সামনে আসে। প্রশ্নটি হলো পাকিস্তান কি ১৯৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমরা সহযোগিতা নেবো ১৯৭৪ সালের ১১ এপ্রিল New York Times পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের। সরাসরি রিপোর্টে কী লেখা আছে সেটা জানার আগে আমরা আরও কিছু বিষয় একটু জেনে নিতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার তার মধ্যে অন্যতম।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশদের ২০০ বছরের নির্মম শাসনের হাত থেকে মুক্তি পায় ভারতবর্ষ। সৃষ্টি হয় দুটি স্বাধীন দেশ পাকিস্তান এবং ভারতের। একই সাথে অনেক অঞ্চল থেকে যায় বিভিন্ন স্বাধীন রাজার অধীনে, যারা পরবর্তীতে ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে পারবে এই মর্মে চুক্তিপত্র ছিল ব্রিটিশ সরকারের সাথে। তবে সেই সকল অঞ্চলগুলোর মতামত উপেক্ষা করেই সেগুলো একপ্রকার দখলের পথে হাঁটে ভারত। সিকিম এবং হায়দ্রাবাদ ছিল অন্যতম। এই দুটি অঞ্চলই ভারত দখল করে নেয়।

India Occupied Hydrabad
Photo Credit: Wikipedia

অন্যদিকে পাকিস্তান স্বাধীনতার মাধ্যমে একটি ত্রুটিপূর্ণ ভূখণ্ডের অধিকারী হয়। প্রায় ১ হাজার মাইল দূরত্বের দুটি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। মূলত ধর্মের ভিত্তিতেই ভারত ভাগ হয়ে যায়। এই ভাগ অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা এমন ছিল যে একই রাষ্ট্র কাঠামোতে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে বাস করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরির পর থেকেই একের পর এক মতবিরোধ সৃষ্টি হতে থাকে তার দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে। প্রথম মতবিরোধ ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারা বাংলা ভাষায় কথা বলতো। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষজন কোনো একক ভাষায় কথা বলতো না। বরং কয়েকটি ভাষায় তারা কথা বলতো। তবে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উচ্চ বংশীয় মুসলিমরা উর্দু ভাষায় কথা বলতো। পুরো ভারতবর্ষেই ইসলামের প্রচার ও প্রসারে উর্দু ভাষার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। যেহেতু ইসলাম ধর্মকে সামনে রেখে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি, তাই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা তৈরির ব্যাপারে একধরনের মতৈক্য ছিল সেই সময়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে। এই বিষয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এক ভাষণে বলেন Lingua Franca হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হবে এবং প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য মাতৃভাষা ব্যবহার করবে।

১৯৪৮ সালে মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে পাকিস্তান এক গভীর সংকটে পড়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। সেই সময়ে কমিউনিস্ট নেতাদের দৌরাত্ম ছিল। আমেরিকার সাথে মিলিত হয়ে পাকিস্তান কমিউনিস্ট বিরোধী অভিযান শুরু করে। মূলত পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি দলেই কমিউনিস্ট মতাদর্শের নেতারা ছিলেন। ফলে পাকিস্তান অথোরিটি নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, পাছে রাষ্ট্রে কমিউনিজমের মতাদর্শ ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিষয়ে আমেরিকার standpoint ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শের নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে গভর্নরের শাসন উত্তম।

এরমধ্যেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতা নিহত হলে তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে গভীর রেখাপাত করে। এখান থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ গতি অর্জন করে বাংলাদেশ তথা পূর্ব-পাকিস্তান ভূখণ্ডে। পুরো পাকিস্তান শাসনামল জুড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষের সাথে নানাবিধ বৈষম্য জারি ছিল। সর্বশেষ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করলেও তাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তান অথোরিটির চালানো গণহত্যা পূর্বপাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করে।

পাকিস্তান কি ১৯৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়েছে?

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা সংঘটিত করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে এটি অনুমেয় ছিল যে তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার করা হবে। প্রায় ৯৩ হাজার হানাদার বাহিনীর সদস্য এবং সিভিলিয়ান আত্মসমর্পণ করে, যার মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ছিলেন। তাদের সবাইকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারতে পাঠানো হয়। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার সেনাবাহিনীর সদস্যও ছিলেন।

ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত সরকার জেনেভা কনভেনশনস অনুযায়ী বন্দী বিনিময়ের চুক্তি করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৩ সাল থেকে বন্দী বিনিময় শুরু হয়, যার ফলে অনেকেরই বিচার করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন সামরিক অফিসারের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার পক্ষে ছিলেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু তাদের বিচারও করা সম্ভব হয়নি।

সেই সময়ের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করেই সরকার বিচারের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। একদিকে নতুন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন, অন্যদিকে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের কাজ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেই ১৯৭৪ সালের মার্চে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। ফলে ইসলামি দেশগুলোর জোট OIC থেকে স্বীকৃতি এবং সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

অপরদিকে, সরকারের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট নেতাদের দৌরাত্ম্যের কারণে আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশ আগে থেকেই চূড়ান্ত অর্থনৈতিক চাপে ছিল। এই সংকটপূর্ণ সময়ে পাকিস্তান OIC-তে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে, ১৯৫ জন সামরিক অফিসারের বিচার না করার শর্ত আরোপ করে, যা বাংলাদেশ সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে পাকিস্তান সরকার অফিসিয়ালি বাংলাদেশে তাদের আর্মি কর্তৃক যে ভায়োলেন্স সংগঠিত হয়েছিল বা, তাদের আর্মি যে এক্সসেসিভ পাওয়ার এক্সারসাইজ করেছিলো তার জন্য অফিসিয়ালি ক্ষমা প্রার্থনা করে। পাকিস্তান সরকারের ভাষা ছিল মৈত্রিসূচক এবং তারা গভীরভাবে নিন্দা ও দুঃখপ্রকাশ করে তাদের আর্মি বাংলাদেশে যেই অপরাধ সংঘটিত করেছে তার জন্য। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনুরোধ করেন যেন তারা পূর্বের সবকিছু ভুলে যান এবং তাদেরকে ক্ষমা প্রদান করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের নৃশংসতা এবং ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকিস্তানের ভূমিকা ভুলে যাবে এবং পাকিস্তানের সাথে নতুন যাত্রা শুরু করবে।

যদিও পাকিস্তানের তরফ থেকে বাংলাদেশের চাওয়া অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার জন্য সরাসরি ক্ষমা চাওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ এবং ভারত ঐক্যমত্যে পৌঁছায় যে, পাকিস্তান স্বীকার করেছে তাদের কিছু সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার করেছে। তবুও এই এগ্রিমেন্টকে বাংলাদেশ ও ভারত ক্ষমা প্রার্থনা হিসেবে দেখে।

উক্ত এগ্রিমেন্টে বাংলাদেশ একটি স্টেটমেন্ট যুক্ত করে। যেখানে বলা হয়েছে ১৯৫ জন পাকিস্তান আর্মির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যাদের বিচার বাংলাদেশ শুরু করতে চেয়েছিল, তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এক্সেসিভ ফোর্স ব্যবহার করেছিল এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত ছিল। সেই সাথে তারা যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা সংগঠিত করেছিল। এই এগ্রিমেন্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষে আজিজ আহমেদ, বাংলাদেশের পক্ষে কামাল আহমেদ এবং ভারতের পক্ষে স্মরণ সিং এগ্রিমেন্টটি স্বাক্ষর করেন।

যেহেতু, বাংলাদেশের করা উপরিউক্ত স্টেটমেন্ট থাকার পরেও পাকিস্তান সরকার সেখানে স্বাক্ষর করেছে, এখান থেকে এটা অনুমেয় যে তারা বাংলাদেশের করা দাবি মেনে নিয়েই স্বাক্ষর করেছে। সেই সাথে এটাও প্রতীয়মান হয় তারা ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। এই ক্ষমা প্রার্থনা ছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের। যেখানে ভারতের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এটা কোনো মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনা ছিল না। একটি এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে তারা ক্ষমা চেয়েছিল এবং বাংলাদেশ এগ্রিমেন্টের মাধ্যমেই ক্ষমা প্রদান করেছিল। সুতরাং, এটা বলা যায় যে, পাকিস্তান তাদের কৃতকর্মের জন্য অফিসিয়ালি বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

Table of Contents

Read more

Related Posts

Join our community of SUBSCRIBERS and be part of the conversation.

To subscribe, simply enter your email address on our website or click the subscribe button below. Don’t worry, we respect your privacy and won’t spam your inbox. Your information is safe with us.

32,111

Followers

32,214

Followers

11,243

Followers