Saturday, April 26, 2025

আবু জাফরের রাজভবন থেকে বঙ্গভবন বুক রিভিউ

রাজভবন থেকে বঙ্গভবন

Share

আজকে আমরা যেই বইটি রিভিউ করতে চলেছি সেটি হলো আবু জাফরের লেখা রাজভবন থেকে বঙ্গভবন বইটি। তাহলে চলুন আমরা বইটি রিভিউ করি।

পূর্ব-বাংলার রাজনীতি ও ক্ষমতা বরাবরই আবর্তিত হয়েছে রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে। কখনো ঢাকা ছিলো প্রাদেশিক রাজধানী আবার কখনো ছিলো বিভিন্ন রাজা-বাদশাদের প্রতিষ্ঠিত রাজধানী। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা পায় একটি স্বাধীন সার্বোভৌম দেশের রাজধানীর মর্যাদা। সুদীর্ঘকাল ধরে ঢাকাকে কেন্দ্র করে পূর্ব-বাংলার যে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলো রাজাদের আমলে রাজভবন, ব্রিটিশদের সময় লাট ভবন এবং পাকিস্তান আমলে তা পরিচিতি পায় গভর্ণর হাউজ নামে। যা বর্তমানে বঙ্গভবন হিসেবে পরিচিত। লেখকের ভাষায়, এই বঙ্গভবন হয়েছে কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, কখনও সাংবিধানিক শ্রেষ্ঠত্বের অলংকার। পাল আমলের রাজভবন থেকে বর্তমান আমলের বঙ্গভবন রাজনৈতিক উত্থান-পতনের এক সুদীর্ঘ ইতিহাসের স্বাক্ষী। মূলত ‘রাজ ভবন থেকে বঙ্গভবন’ বইটি সংক্ষিপ্ত আকারে সেই ইতিহাসকেই তুলে ধরেছে।

বইটি লিখেছেন আবু জাফর মোঃ ইকবাল। তিনি মূলত একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি সূত্রে তাকে বঙ্গভবনে কর্মরত থাকতে হয়েছে। ২০০১ সালে বঙ্গভবনে কর্মরত থাকা অবস্থায় সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী লেখককে বঙ্গভবন সম্পর্কে একটি শর্ট-ফিল্ম বানাতে বলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির আকস্মিক পদত্যাগের কারনে কাজটি আর শুরু করা যায়নি। তবে লেখকের বঙ্গভবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ এক সময় এই বইটি লিখতে তাকে অনুপ্রাণিত করে।

আগেই বলেছি বইটি লিখিত হয়েছে বঙ্গভবনকে কেন্দ্র করে। বলা যেতে পারে বঙ্গভবনের সাথে জড়িত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা কূটনৈতিক যে ঘটনা প্রবাহ তারই চিত্র উঠে এসেছে বইটিতে। বইটি মূলত ১০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ধারা শিরোনামে প্রথম অধ্যায়ে লেখক মূলত তুলে ধরেছেন কিভাবে বঙ্গ থেকে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো। খুব সংক্ষিপ্তভাবে লেখক এই অধ্যায়ে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব-বাংলা কখন কি নামে পরিচিত ছিলো এবং কারা কখন এই অঞ্চল শাসন করেছেন তা তুলে ধরেছেন। কিভাবে হিন্দুদের রাজত্ব মুসলিমদের নিকটে আসে এবং পরবর্তী সময়ে তা ব্রিটিশদের হাত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় তাই বর্ণনা করা হয়েছে এই অধ্যায়ে।

স্মৃতি-বিস্মৃতির অতীত কথা শিরোনামে দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক প্রাক মোগল যুগ, তুর্কী ও আফগান শাসন, ইলিয়াস শাহী আমল, হোসেন শাহী শাসনামল, এবং আফগান শাসনামল সম্পর্কে আলোকপাত করেন। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা ও বিহার জয় এবং সুলতানী শাসনের গোড়াপত্তন সম্পর্কে লেখক এই অধ্যায়ে আলোচনা করেন।

এরপর তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক মগল যুগে রাজধানী হিসেবে ঢাকা শিরোনামে ঢাকা কেন্দ্রীক ক্ষমতার লড়াই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মোগল প্রতিনিধি ইসলাম খান চিশতি প্রথমে ঢাকাকে রাজধানীর মর্যাদা প্রদান করেন। এই সময়ে ঢাকার নাম ছিলো জাহাঙ্গীরনগর। আজমখানের সময় প্রথম ইংরেজদের ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হয়। তবে ইংরেজদের গতিবিধি হুগলী নদীর পিপলাই বন্দরে সীমাবদ্ধ ছিলো।

এই সময়ে সম্রাট শাহজাহানের কন্যার কাপড়ে আগুন লেগে যায়। অনেক চিকিৎসার পরেও যখন সুস্থ করা যাচ্ছিলো না, তখন ইংরেজ শল্য চিকিৎসক মি. বাটন তাঁর কন্যার চিকিৎসা করান এবং নিরাময় করে তোলেন। তিনি সম্রাটের কাছে বিনা শুল্কে ও খাজনায় বাংলায় ইংরেজদের জন্য ব্যবসায়ের অনুমতি প্রার্থনা করলে সম্রাট তা মঞ্জুর করেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর তার চার ছেলে শাহজাদা শুজা, দারা, মুরাদ এবং আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসন লাভের চেষ্টা করেন। চার ভাইয়ের অনেক লড়াই সংগ্রামের পর আওরঙ্গজের সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হন।

নবাবী আমল শুরু হলে রাজধানী ঢাকা স্থানান্তরিত হয় মুর্শিদাবাদে। চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক মুর্শিদাবকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতি এবং ক্ষমতার পালাবদল ঘটতে থাকে তা তুলে ধরেন। নবাবী আমলে ঢাকা আবার তার রাজধানীর মর্যাদা হারায়। মুর্শিদাবাদেই ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে। নতুন সম্রাট হন মীর জাফর। কিন্তু মূল ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে।

এরপর লেখক কোম্পানি আমলে এবং ব্রিটিশ শাসনে ঢাকার অবস্থা বর্ণনা করেন। শাসনের নামে শোষণের সুদীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরেন লেখক। সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে ১৮৫৭ সালে শেষ হয় কোম্পানি শাসন, শুরু হয় ব্রিটিশ রাজের শাসন। বড় লাট লর্ড ক্যানিং নিযুক্ত হন ভারতের প্রথম ভাইসরয়। স্যার হ্যালিডের সময় ১৮৫৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিবাহ সম্পর্কে আইন চালু হয়। স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল প্রদেশের রাজস্ব আয়-ব্যয় বিকেন্দ্রিকরণ করেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পুনরায় ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। তবে ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দলোন শুরু হলে, ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সম্রাট বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেন এবং রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করেন। এই সময়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে আবার ঐতিহাসিক লাহোরে প্রস্তাব এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে নতুন দুইটি দেশ সৃষ্টি হয়। একটি ভারত এবং অপরটি পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুইটি অংশ, পূর্ব আর পশ্চিম। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে আবার ঢাকা নতুনভাবে মর্যাদা লাভ করে। ফ্রেডরিখ চার্লমার বোর্ন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অনেকেই হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। লেখক প্রত্যেক গভর্নরের আমল, তাদের কাজ এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশদ লিখেছেন। পাকিস্তান আমলে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুল মোনায়েম খান। তিনি ১৮৯৯ সালের ২৮ জুলাই কিশোরগঞ্জ-এ জন্মগ্রহণ করেন। কর্মময় জীবন শেষে পূর্ব পাকিস্তানে অবসরে থাকা অবস্থায় মুক্তি বাহীনির এক সদস্যের হাতে তিনি ঢাকাস্থ নিজ বাড়িতে নিহত হন।

পাকিস্তান শাসন আমলে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গভর্নর ছিলেন আজম খান। তাঁর বিদায়ে বাংলার সাধারন জনগন যারপরনায় ব্যাথিত হন। জেনারেল টিক্কা খান গভর্নর থাকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তার সময়েই ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে ঢাকার জনগনের ওপর চালানো হয় অপারেশন সার্চ লাইট। এতে ছাত্র-জনতা সহ নিহত হন অনেক মানুষ। ডা. এ এম মালিক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ গভর্নর।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গভবন কখনো হয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু আবার কখনো হয়েছে সাংবিধানিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি স্বাশিত সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হলো বঙ্গভবন আর পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কেন্দ্র হলো গনভবন। ১৯৭১ সালের পর থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রায় বেশিরভাগ সময় বঙ্গভবন ছিলো ক্ষমতার মূল কেন্দ্র বিন্দু। এই সময়ে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনার স্বাক্ষী এই বঙ্গভবন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাকশাল গঠন ও তাঁর হত্যা, জিয়াউর রহমানের হত্যা সহ আরো অনেক ঘটনাবহুল ইতিহাসের স্বাক্ষী বঙ্গভবন।

বইটি রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ পর্যন্ত যতজন রাষ্ট্রপতি হয়ে বঙ্গভবনে এসেছেন তাদের সবার কর্মপরিধি, জীবন ও সেই সময়ে বঙ্গভবনের নিয়ম-কানুন, সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছে। একই সাথে সেই সময়গুলোতে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। যারা বঙ্গভবনের ইতিহাস জানতে আগ্রহী তাদের জন্য বইটি আদর্শ হতে পারে। দীর্ঘ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের এক তথ্যবহুল সংকলন এই বইটি। অনেক না জানা ইতিহাস, রাজনৈতিক দিক এবং ঘটনা প্রবাহের অবতারণা দেখতে পারবনে একজন পাঠক এই বইটিতে। বইটি ইতিহাস গবেষকদের জন্য এক অতি মূল্যবান সম্পদ হতে পারে। সর্বোপরি, বইটি পড়ার আহবান থাকবে পাঠকদের কাছে।

Table of Contents

Read more

Related Posts

Join our community of SUBSCRIBERS and be part of the conversation.

To subscribe, simply enter your email address on our website or click the subscribe button below. Don’t worry, we respect your privacy and won’t spam your inbox. Your information is safe with us.

32,111

Followers

32,214

Followers

11,243

Followers