তলস্তয়ের পরিচিতি
কাউন্ট লিও নিকোলায়েভিচ তলস্তয় একজন শক্তিমান লেখক। তাঁকে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা লেখকদের একজন বলে মনে করা হয়। তিনি ১৮২৮ সালের ২৬ আগস্ট রাশিয়ার ইয়াসিনা পলিয়ানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অনেকগুলো বিখ্যাত লেখার মধ্যে “ওয়ার এন্ড পিস” অন্যতম। বিখ্যাত এই উপন্যাসটি তাকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এবং সম্মান এনে দেয়। তাঁর লেখা দীর্ঘতম উপন্যাসের মধ্যে এটি একটি এবং অপরটি হলো ‘আন্নাক্যারেনিনা‘।
“ওয়ার এন্ড পিস” উপন্যাসের পটভূমি
ওয়ার এন্ড পিস উপন্যাসটি ১৮০৫ থেকে ১৮১২ সাল ব্যাপি রাশিয়া এবং ফ্রান্সের যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি ফিকশোনাল উপন্যাস। উপন্যাসটি সেই সময়ের অভিজাত শ্রেণীর দৃষ্টিতে যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। সেই সময়ের ফরাসী অভিজাত শ্রেণীর জীবন-যাত্রার কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধের কাহিনী প্রতিভাত করেছেন।
কাহিনীর সূচনা এবং চরিত্র
ঘটনার বর্ণনা শুরু হয়েছে সেন্ট পিটাসবার্গের আন্না পাভলভনার বাড়িতে আড্ডার মধ্যে দিয়ে। এরপর একে একে প্রিন্স আন্দ্রু, পিয়ের বেজখুভ, প্রিন্স ভাসিলি, রুস্তভ প্রমুখদের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের প্লট। মাঝে মাঝেই কাহিনী প্রবাহে ছেদ এনে লেখক তুলে ধরেছেন তার দার্শনিক চিন্তাধারা।
যুদ্ধের ঘটনা এবং নেপোলিয়নের পতন
উপন্যাসটি ফরাসী অভিজাত শ্রেণীর সমাজ বাস্তবতার নিরিখে সেই সময়ে নেপোলিয়ন এবং সম্রাট আলেক্সান্ডারের মধ্যে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, সন্ধি এবং নেপোলিয়ন কর্তৃক মস্কো অভিযানের কথা তুলে ধরেছেন। ফ্রান্সের প্রায় ছয় লাখ সৈন্য নিয়ে গঠিত শক্তিশালী সেনাবাহিনী যখন একের পর এক অঞ্চল জয় করছিলো, তখন রাশিয়ার সৈন্যরা খেই হারিয়ে একদিকে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছিলো, অন্যদিকে প্রতিঘাত হানতে না পেরে ক্রমাগত তাদের পিছু হটতে হচ্ছিলো।
বরদিনো যুদ্ধ এবং মস্কোর পতন
বরদিনো যুদ্ধে ফরাসী বাহিনী, রাশিয়ার শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়লেও পরবর্তীতে বিনা বাধায় মস্কো দখল করতে সমর্থ হয়। সেই সময়ে রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি কুতজুভ বরদিনো যুদ্ধে তাদের বিজয় দাবি করলেও, অনেকেই তা মেনে নিতে পারেন নি।
মস্কোর দখল এবং ফরাসি বাহিনীর বিপর্যয়
মস্কো বিজয়ের পর নেপোলিয়নের বাহিনী শহরজুড়ে চালাতে শুরু করলো লুটপাট। শৃঙ্খলিত সৈন্যরা হয়ে উঠল দস্যু। মস্কো পরিণত হলো ছাই এবং ধোঁয়ার নগরীতে। এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে মস্কোতে দেখা দিল সৈন্যদের রসদ ঘাটতি। ফলশ্রুতিতে এত বড় বিশাল সৈন্যবহরের অনেকেই তীব্র ঠান্ডায় মৃত্যুবরণ করতে শুরু করল।
নেপোলিয়নের পিছু হটা এবং পরাজয়
অপরদিকে রসদ এর অভাবে সৈন্যরা প্রাণ হারাতে শুরু করলো, শহরজুড়ে চোরাগুপ্তা হামলা শুরু হলো। তখন এই পরিত্যক্ত শহরই পরিণত হল ফরাসিদের মরণফাঁদে। বাধ্য হয়ে নেপোলিয়নকে মস্কো ছেড়ে পিছু হটতে হল ফ্রান্সের পথে। কিন্তু তিনি এমন রাস্তা ধরে পিছু হটতে শুরু করলেন যেই অঞ্চল আগেই যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রেম কাহিনী এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ
যুদ্ধের এই কাহিনীর সাথে সমান্তরালে উঠে এসেছে পৃথিবীর কিছু সুন্দরতম প্রেম কাহিনী। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে লেখক লিখেছেন প্রিন্স অন্দ্রু, নাতাশা, পিয়ের, রুসতভ ও প্রিন্সেস মারির প্রেমের গল্প। উঠে এসেছে সোনিয়ার আত্মত্যাগ, আন্দ্রুর মৃত্যু এবং তার প্রতি নাতাশার সীমাহীন ভালোবাসার কথা।
দার্শনিক চিন্তাধারা
দ্বিতীয় বা শেষ পরিশিষ্টে লেখক যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর দার্শনিক চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলছেন জাতি ও মানুষকে নিজেকে চিনতে শেখানোই তো ইতিহাসের লক্ষ্য। তিনি আরো বলেছেন, যুদ্ধ কখনোই মানব কল্যাণের বিষয় হতে পারে না।
উপসংহার
ঐতিহাসিক এই উপন্যাসে যেমন যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে, সেই সাথে তিনি এটাও বলেছেন, যুদ্ধ কখনোই মানবকল্যাণের জন্য হয় না। তলস্তয়ের “ওয়ার এন্ড পিস” এর সমতুল্য সৃষ্টি পৃথিবীতে বিরল।